মেলবোর্নের দিনলিপিঃ ঘরে ফেরা, অনিশ্চিত পথে...(ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব)
মায়া ধরানো মেয়ে রোযালী চলে যাবার পর থেকে আমরাও নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকলাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বের হ’লাম সেই দোকানটিতে স্যুপ ও বীফ নুডলস খাওয়ার জন্য। চমৎকার ছিল দুটোই, তৃপ্তির সাথে খাওয়ার পর পেট পুরোপুরি ভরে গেল। সে স্বাদটা যেন এখনো মুখে লেগে আছে। ফিরে এসে ব্যাগ গুছিয়ে বসে থাকলাম। একটু একটু টেনশন লাগছিল। চায়না সাউদার্ন এর স্টাফ নিশ্চিত করার পরেও কেন যেন মনে হচ্ছিল, আমাদের চেকড-ইন লাগেজগুলো আমাদের সাথে যাবে না, দু’দিন আগেই ওগুলো ঢাকা চলে গেছে। তার পরের টেনশনটা ছিল, ঢাকায় নেমে কি পরিস্থিতিতে পড়বো! কেউ বলে আশকোনা হজ্জ্ব ক্যাম্পে নিয়ে যাবে, কেউ বলে টঙ্গী ইজতেমা মাঠে আর্মী কোয়ারেন্টাইনে পাঠাবে, সেখানে ১৪ দিন কাটানোর পর বাসায় যাবার অনুমতি মিলবে, ইত্যাদি নানা রকমের তথ্য সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছিলাম। গুয়াংঝুতে বসেই জেনেছি, ঢাকায়ও ‘লকডাউন’ শুরু হয়ে গেছে। আমরা মধ্যরাতে ঢাকা পৌঁছাবো, এত রাতে আমার ছেলে পুলিশ আনসারের জেরা কাটিয়ে উঠে আমাদেরকে রিসীভ করার জন্য এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে পারবে তো? ইত্যাদি নানারকমের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
যথাসময়ে ডিনার বক্স সার্ভ করা হয়েছিল, কিন্তু ঘন্টা দেড়েক আগে স্যুপ ও নুডলস খাওয়ার কারণে পেট ভরা থাকায় সন্ধ্যে ছয়টার সময় সে খাবার খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। সময়ও কাটছিল না। সেই আমেরিকান দম্পতি তখনো ঘুমুচ্ছিলেন। আমরা নিভৃতে একটা কোণায় বসে প্রথমে মাগরিবের এবং তার একটু পরে এশার নামায পড়ে নিলাম। রাত সোয়া আটটার দিকে চায়না সাউদার্ন এর স্টাফ এসে আমাদের খোঁজ করলেন, আমরা তৈরী আছি কিনা তা দেখে নিলেন। চেয়ারের উপর রাখা ডিনার বক্সগুলো দেখে তিনি বললেন, এগুলো যেহেতু চায়না সাউদার্ন কর্তৃক সরবরাহকৃত, ইচ্ছে করলে আমরা বক্সগুলো প্লেনেও নিয়ে যেতে পারি, সেখানে খেতে পারি। তার কথা শুনে আমরা বক্সগুলো সাথে নিলাম। আমাদের অদূরে মুখে মাস্ক লাগানো এক যুবক বসে ছিলেন। ট্রানজিট এরিয়া থেকে ওয়াশরুমে যাওয়া আসার পথে লক্ষ্য করলাম, যুবকটি আমার মুখের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে যখন গিন্নীর সাথে বাংলায় কথা বলছিলাম, যুবকটি তখন মন দিয়ে আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন। তিনি ঠিক কখন এসে ওখানে বসেছেন, তা খেয়াল করিনি। চায়না সাউদার্ন এর স্টাফ আমার সাথে কথা বলার পর ওনার সাথেও কিছু কথা সেরে নিলেন। তারপর তিনি আমাদেরকে ইশারা করলেন তাকে অনুসরণ করতে। আমরা বোর্ডিং এর উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম।
আমার দু’হাতে দুটো ব্যাগ ধরা দেখে যুবকটি আমার কাছে এসে পরিস্কার বাংলায় আমার কাছ থেকে একটা ব্যাগ বহন করার জন্য তাকে দিতে বললেন। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাঙালি’? উনি জানালেন, হ্যাঁ। চলতে চলতেই তিনি একটি ব্যাগ আমার হাত থেকে নিয়ে জানালেন, তার নাম মোহাম্মদ সাজাদুল ইসলাম, তার বাড়ী দিনাজপুর। ভেঞ্চুরা লেদার ওয়্যার নামে একটি কোম্পানীর ইন্টার্নাল অডিট বিভাগে তিনি অডিটর হিসেবে কর্মরত আছেন। কোম্পানী একটা জরুরী কাজে তাকে চীন পাঠিয়েছিল, ফেরার পথে তিনি আটকা পড়েছেন। তার আচরণে সত্যিই আমি খুব মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমার মত অচেনা একজন সাধারণ ব্যক্তিকে তিনি যে সৌজন্য ও সম্মান দেখালেন, এটা তার বংশের এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের একটা সামারী পরিচয় আমার কাছে রেখে গেল।
বোর্ডিং গেইটে এসে চায়না সাউদার্ন এর সেই স্টাফ নতুন একদল স্টাফের কাছে আমাদেরকে হস্তান্তর করে শুভবিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। আমাদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে একজন স্টাফ এসে এক এক করে শরীরের তাপমাত্রা মেপে নিলেন এবং তা কাগজে টুকে নিলেন। তাপমাত্রা মাপার পর দুই একজনকে লাইন থেকে আলাদা করে বের করে নিয়ে দূরে একটি জায়গায় বসিয়ে দিলেন। অনুমান কররলাম, তাদের শরীরে হয়তো তাপমাত্রা অনুমোদিত সীমার চেয়ে বেশী পাওয়া গেছে। তারপর আমাদেরকে গেইট থেকে বের হয়ে অপেক্ষমান একটি বাসে উঠতে বললেন। বাসে উঠে দেখি, গিন্নী আর আমি পাশাপাশি বসবো, একত্রে এমন দুটো আসন খালি নেই। কারণ, অনেকেই করোনাভীতি জনিত কারণে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য একটি করে আসন ফাঁক রেখেই বসেছেন। অগত্যা গিন্নীকে একটা খালি আসন দেখিয়ে সেখানে বসতে বললাম, আমি উপরের হ্যান্ডেল ধরে একটি আরামদায়ক অবস্থান গ্রহণ করলাম। এটা দেখে আমার স্ত্রীর পাশে বসা একজন কমবয়সী (আমাদের চেয়ে) মহিলা একটু সরে গিয়ে পাশের আসনে বসলেন, যেন আমি এসে আমার স্ত্রীর পাশে বসতে পারি। তারপর আমাকে ইশারায় তার ছেড়ে দেয়া আসনটিতে বসতে বললেন। প্রয়োজন ছিল না বসার, কারণ আমি দাঁড়ানো অবস্থাতেও কমফোর্টেবল ছিলাম। শুধু তার বদান্যতায় মুগ্ধ হয়ে আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে খালি আসনটি গ্রহণ করলাম।
প্লেনে উঠে দেখি, প্রায় সব আসন খালি। সব মিলিয়ে ইকনমি ক্লাসে বিশ পঁচিশ জন যাত্রী হবে। তার পরেও অবাক হ’লাম, যখন দেখলাম আমাদের আসনটি প্লেনের একেবারে লেজের শেষ সারিতে। হয়তো ওজনের সুষম বন্টনের জন্য এমনটি করা হয়েছে। শিডিউল অনুযায়ী ঠিক আটটা পঞ্চান্নতেই প্লেনটা নড়ে উঠলো। সোয়া নয়টায় আকাশে পাখা মেলার পর বিমানবালারা খাদ্য পরিবেশন করলেন। প্রায় চার ঘন্টার রাত্রির ফ্লাইট, সেই হিসেবে ওদের ডিনার দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু যা দিয়ে গেল, তাকে বড় জোর স্ন্যাক্স বলা চলে। মনে মনে চায়না সাউদার্ন এর সেই স্টাফকে ধন্যবাদ জানালাম, যিনি আমাদেরকে ট্রানজিট এরিয়ায় দেয়া ডিনার বক্সগুলো ক্যারী করতে বলেছিলেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে কতক্ষণ কাটাতে হবে, তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। তাই আমরা স্ন্যাক্সগুলো রেখে দিয়ে সাথে আনা ডিনারবক্স খুলে ফেললাম। মুশকিল হলো, স্ন্যাক্স এর সাথে ওরা কোন ডিসপোজেবল স্পুন বা ফোর্ক, কোন কিছুই দেয় নি। ট্রানজিট এরিয়াতে অবশ্য দিয়েছিল, কিন্তু আমরা সেগুলো ফেলে এসেছিলাম। আমরা যেহেতু শেষ সারিতে বসা ছিলাম, ঘাড় ঘুরালেই কেবিন ক্রুদের নির্ধারিত জায়গায় ওরা কে কী করছে, তা দেখতে পেতাম। দেখলাম, বয়স্কা একজন বিমানবালা তার ডিনারবক্স খুলে খাওয়া শুরু করেছেন, এবং তার মেন্যু ঠিক তাই, যা আমরা ট্রানজিট এরিয়া থেকে ক্যারী করে এনেছি। বসে বসেই আমি তার কাছে এক জোড়া ডিসপোজেবল কাটলারিজ এর প্যাকেট চাইলাম, তা না হলে প্লেনে বসে ভাত খাবো কি করে? উনি খাওয়া থেকে ওনার ফোকাস অন্যত্র সরাতে চাইলেন না, ইশারায় অন্য একজন বিমানবালাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তাকে বলাতে তিনি মাত্র একটি সেট প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বললেন, তাদের কাছে আর নেই। উনি ওনার ব্যক্তিগত কিট থেকে ওটা দিয়ে গেলেন। আমি ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ডিনারে মনোনিবেশ করলাম। আমরা একজন স্পুন দিয়ে খেলাম, আরেকজন ফোর্ক দিয়ে। কোন অসুবিধে হলো না।
নির্ধারিত সময়ের পঁচিশ মিনিট আগে, রাত এগারটায় প্লেন ঢাকায় ল্যান্ড করলো। বাসায় বসে ছোট ছেলে ফ্লাইট ট্র্যাকারে আমাদের ফ্লাইটের গতিবিধি মনিটর করছিল। প্লেন রানওয়েতে টাচ ডাউন করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে তার ফোন পেলাম। তাকে জানালাম, আমরা ল্যান্ড করেছি। সে বললো, হ্যাঁ, আমিও ট্র্যাকারে দেখলাম, তোমাদের প্লেন ল্যান্ড করেছে। তাকে বললাম, তুমি আপাততঃ বাসায়ই থাকো। আমাদের ইমিগ্রেশন হয়ে গেলে আমি তোমাকে কল করবো। তবে আধা ঘন্টার মধ্যে আমার কোন কল না পেলে তুমি নিজে থেকেই রওনা দিয়ে দিও। আমাদের বোর্ডিং পাসের ছবি ওর কাছে আগেই পাঠিয়েছিলাম। ওকে বললাম, পুলিশ কিছু বললে প্রমাণ হিসেবে বোর্ডিং পাসের ছবিগুলো দেখাইও।
অনিশ্চিত আশঙ্কার দোলাচলে বুকটা দুলছিল। মধ্যরাত, কি বিপদ না জানি নেমে আসে! প্লেন থেকে বের হয়ে এসে দেখলাম, কয়েকজন আনসার ও পুলিশ আগত যাত্রীদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে গাইড করছেন। প্লেনে একটা ফর্ম (হেল্থ কার্ড) দেয়া হয়েছিল যা আগেই পূরণ করে রেখেছিলাম। সেটা নিয়ে প্রথমে স্বাস্থ্য বিভাগের স্টাফদের সম্মুখীন হ’লাম। একজন মহিলা ফর্মটির উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে কিছু গতবাধা প্রশ্ন করলেন, যা এতদিন ধরে শুনতে শুনতে মুখস্থের মত হয়ে গিয়েছিল। আমি ঝটপট উত্তর দিলাম। উনি আমাদেরকে মৌখিকভাবে কোন কিছু ব্রীফ না করে স্বাস্থ্য বিভাগের একটি লীফলেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনাদের এখন কি করণীয় এবং অকরণীয়, সবই এটাতে লেখা আছে। বাসায় গিয়ে মনযোগ দিয়ে তা পড়বেন এবং সেই অনুযায়ী কাজ করবেন। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম।
ইমিগ্রেশনের লাইনে এসে দেখি, সেই যুবক সাজাদুল আমার পেছনে। সে জানালো, তার কোম্পানীর ড্রাইভার তাকে বলেছে, আগামীকাল থেকে দেশে “কমপ্লিট লকডাউন” শুরু হতে যাচ্ছে। তাদের উত্তরার অফিস দু’সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। সে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। সে জানালো, সে দিনাজপুরে চলে যাবে, এবং আজকে রাতেই একটু পরে শেষ বাসটা ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে। তার কথার আর্জেন্সী আমি বুঝতে পারলাম। তার মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও তাকে আমি পেছন থেকে টেনে এনে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলাম, ঠিক যেভাবে সে আমার মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও আমার হাত থেকে ব্যাগটা টেনে নিয়েছিল। আমি তাকে বললাম, আমি ঢাকায় থাকি এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছে গেছি, তখন আশাকরি আমাদের আর কোন সমস্যা হবেনা। তুমি শেষ বাসটি ধরে দিনাজপুর না পৌঁছাতে পারলে পথে তোমার ভোগান্তির শেষ থাকবে না। সে এ কথা শুনে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। সাজাদুলের পর আমি ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে অগ্রসর হ’লাম। উনি পাসপোর্ট দেখতে দেখতে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে বেশ গল্প জুড়ে দিলেন। মাস্ক ও মাথার ক্যাপ খুলে সামনের ওয়েবক্যাম এর দিকে তাকাতে বলে চেহারা মিলিয়ে নিলেন। তার পর শার্টের আস্তিন গোটাতে বললেন। স্ট্যাম্প প্যাড বের করে সেখানে একটি সীল চাপ দিয়ে ধরে সীলটি আমার কব্জী ও কনুই এর মাঝখানে স্ট্যাম্প করে দিলেন। কৌতুহল হলো, সীলে কী লেখা আছে সেটা দেখার। দেখি, মাঝখানে বড় করে লেখা “PROUD TO PROTECT”, আর চারপাশে ছোট করে আরো কি যেন লেখা ছিল। তারপর হাতের বুড়ো আঙুল বের করতে বললেন। নির্বাচনের সময় যেভাবে হাতের বুড়ো আঙুলে কালি লেপন করে দেয়া হয়, সেভাবেই তিনি বুড়ো আঙুলে কালি মেখে দিলেন। আমার পরে আমার স্ত্রী তাঁর সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রেও তিনি একই প্রক্রিয়ায় কাজ করলেন। তাকিয়ে দেখলাম, অন্য কাউন্টারগুলোতেও একই প্রক্রিয়া চলছে। এভাবেই আমাদের ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবার পর জাতি হিসেবে আমাদের অসভ্যতার স্মারক আমরা হাতে আঙুলে মেখে নিয়ে কনভেয়র বেল্টের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম।
৫ নং কনভেয়র বেল্টে আমাদের লাগেজ আসার কথা। বেল্টের অদূরে এসেই লক্ষ্য করলাম, আমাদের কনভেয়র বেল্টটা থেমে আছে। ভয়ে ভয়ে কাছে আসলাম। আলহামদুলিল্লাহ! আমি যেখানে এসে দাঁড়ালাম, দেখলাম ঠিক সেখানেই আমাদের লাগেজগুলো পাশাপাশি রাখা আছে। আমাদেরকে কনভেয়র বেল্টের কাছে আসতে দেখে দূর থেকে একজন লোক একটা লাগেজ ট্রলী ঠেলতে ঠেলতে আমাদের কাছে এসে বললেন, লাগেজ খুঁজে পেয়েছেন স্যার? আমি বললাম জ্বী, পেয়েছি। আমাকে দেখিয়ে দেন স্যার, আমি ট্রলীতে করে লাগেজগুলো আপনার গাড়ীতে তুলে দিয়ে আসবো। আমি বললাম, কত নেবেন? তিনি বললেন, আপনি খুশী হয়ে যা দেবেন তাই স্যার। আমি আমাদের লাগেজগুলো দেখিয়ে দিলাম, উনি সেগুলো ট্রলীতে ওঠালেন। আমি ছেলেকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ওরা কত দূরে আছে। সে বললো ওরা সে মুহূর্তে এয়ারপোর্টে প্রবেশ করছে। আমি বললাম, বেশ, আমরা লাগেজ নিয়ে বের হচ্ছি, তুমি সরাসরি ২ নং টারমিনাল গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করো। গেইট থেকে বের হবার আগে আগে সেই ট্রলীম্যান বললেন, স্যার গেটের বাইরে আমাদের কোন বখশিস নিলে অসুবিধা হয়। পুলিশ, আনসার ওরাও ভাগ চায়। আপনি যা দেবার এখানেই আমাকে দিয়ে দেন। আমার ওয়ালেটে ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া দুটো একশত টাকার নোট ছিল, সে দুটো বের করে ওনাকে দিলাম। উনি আপত্তি করলেন এবং নোট দুটো ফেরত দিলেন। বললেন, স্যার ডলার দেন। আমি ওয়ালেট থেকে একটা পাঁচ ডলারের নোট বের করে ওনাকে দিলাম। নোট পেয়ে উনি ট্রলীটা ওখানে রেখেই সালাম দিয়ে চলে গেলেন। বাকী পথ সামান্যই ছিল। আমি সেটুকু পথ নিজে ট্রলী ঠেলে বের হয়েই ছেলেকে সামনে দেখতে পেলাম। ওরও মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস, ড্রাইভারেরও। ছেলে কাছে এলে করোনা গ্রীটিংস করলাম, অর্থাৎ শুধু মুখে সালাম বিনিময়, নো হাগস!
রাস্তা ফাঁকা থাকাতে খুব দ্রুতই বাসায় পৌঁছে গেলাম। ঘড়িতে দেখলাম, রাত বারটা বেজে চার মিনিট, অর্থাৎ ক্যালেন্ডারের হিসেবে আরও একটা দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ২৩ তারিখ সকালে মেলবোর্ন থেকে রওনা দিয়ে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাসায় প্রবেশ করলাম। স্মরণ করলাম, ৪৯ বছর আগের এই দিনে এই সময়টা ছিল আমাদের স্বাধীনতারও প্রথম প্রহর! গুয়াংঝু বিমান বন্দরের ট্রানজিট এরিয়ার সীমিত পরিসরে দু’দিন কাটিয়ে এসে ঘরে ফিরে যেন মুক্ত স্বাধীনতার আনন্দ অনুভব করতে থাকলাম। বাসায় ঢুকেই দেখতে চাইলাম কব্জী ও কনুই এর মাঝখানে দেয়া সীলের বাকী কথাগুলো কী লেখা আছে। শার্টের আস্তিন গুটিয়ে দেখি, বাসায় প্রবেশের আগেই সে সীল উধাও, সাথে বুড়ো আঙুলের কালিও!
এয়ারপোর্টে পূরণকৃত ফর্মে স্বাক্ষর করে এসেছিলাম যে আগামী ১৪ দিন আমরা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবো, ঘর থেকে বের হবো না। সে প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছি। এ ব্যাপারে আমি আগে থেকেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম। সে প্রতিজ্ঞা পালন করাতে ভালই হয়েছে। কারণ আমরা ফিরে আসার দুই দিন পর থানা থেকে একজন এএসআই বাসায় এসে দেখে গেছেন যে আমরা বাসায় আছি কি না। থানার এ তৎপরতা দেখে খুশী হ’লাম। মনে হলো করোনা বিস্তার রোধে সরকারের কাজ এখন অনেকটা সুসংহত হয়েছে। তারও দুই দিন পর করোনা রোধক ডিউটিতে নিয়োজিত সেনাদল থেকে একজন ওয়ারেন্ট অফিসার এসেও চেক করে গেলেন আমরা বাসায় আছি কিনা। এতে আরও খুশী হলাম। সাজাদুল পরের দিনই আমাকে ফোন করে জানিয়েছে যে সে উত্তরা থেকে ভোর চারটায় বাসে রওনা দিয়ে সন্ধ্যে ছয়টায় বাড়ী পৌঁছেছে। মনে করে ফোন করায়, ওর এই সৌজন্য প্রকাশে এবং ওর নিরাপদে বাড়ী পৌঁছানোর খবর পেয়েও যারপরনাই খুশী হ’লাম।
ঘরে থাকায় এক অনাবিল শান্তি অনুভব করছি। প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিন থেকেই আমাদের এখানে বসন্তের আগমনী বার্তা কোকিলের কুহু ডাকের মাধ্যমে শুনতাম। এ নিয়ে আমি পর পর কয়েক বছর ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম, কোকিল কি করে মনে রাখে যে ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিনটাতেই তাকে কুহু ডাক শোনাতে হবে? এ বছর এখানে ছিলাম না বলে সে ডাক শোনা হয় নি, তবে ওখানেও দুই একদিন শুনেছি। ২৬ তারিখ সকালে ঘুম থেকে জেগে শুনি, অদূরে কোথাও এক কোকিল আনমনে ডেকে যাচ্ছে। খুব ভাল লাগছিল। ব্যালকনিতে এসে দেখি, দেয়ালে রাখা একটি টবে এক জোড়া বুলবুলি পাখি তিনটে ডিমে তা’ দিচ্ছে। আমরা বাসায় না থাকাতে বোধহয় বাসাটা নিরিবিলি পেয়ে ওরা সেখানে নীড় বেঁধেছে। ক’দিন আগে দেখি সে ডিম ফুটে তিনটে পক্ষীশাবকও বের হয়েছে। তার মধ্যে দুটো বেশ ঝরঝরে হয়েছে, একটার অবস্থা নাজুক। পাখিগুলো রোজ কয়েকবার করে খাদ্য আহরণ করে বাচ্চাগুলোর কাছে আসলেই ওরা মাথা উঁচু করে মুখটা হাঁ করে খোলে। পাখিগুলো তাদের মুখের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে খাদ্য পৌঁছে দেয়। প্রথম দিকে অতি ক্ষুদ্র কিছু পোকা মাকড় ধরে আনতো ওদের মা ও বাবা। আজ সকালে দেখি, পক্ষীমাতা একটা পাখাওয়ালা ফড়িং পাকড়াও করে এনে পাখাসহ ওদের মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। ওরা খুব দ্রুত বেড়ে উঠছে। ইতোমধ্যে গায়ে পালকও জন্মেছে। হয়তো খুব শীঘ্রই দেখবো, শাবকগুলো ওড়ার চেষ্টা করছে। চেষ্টা করতে করতে একদিন সত্য সত্যই ওরা ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে অনন্ত আকাশে।
আমার গল্পটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো ..........
ঢাকা
০৮ এপ্রিল ২০২০
শব্দ সংখ্যাঃ ২১৬২
(পুনশ্চঃ এ লেখাটি শেষ হবার পরের দিন দুপুরে দেখি, পাখির নীড় খালি, পক্ষীশাবক উড়াল দিয়েছে, পক্ষীপ্যারেন্টসও ধারে কাছে কোথাও নেই। খুশী হ’লাম, আমার গল্পটি শেষ হবার সাথে সাথে মায়াময় এ জগতের অসীম প্রান্তরে দু’টি নবজীবন শুরু হবার গল্পটিও জুড়ে দিতে পারলাম বলে।)
প্লেনে উঠে দেখি, প্রায় সব আসন খালি ....
প্রায় সব আসন খালি থাকা সত্ত্বেও, সবচেয়ে পেছনের আসনে আমরা দু'জন ....
আমরা বাসায় না থাকাতে বোধহয় বাসাটা নিরিবিলি পেয়ে ওরা সেখানে নীড় বেঁধেছে, তিনটে ডিমও পেড়েছে।
মায়ের কন্ঠের শব্দ পেয়ে দুই পক্ষীশাবক মুখ হাঁ করে বসে আছে, খাদ্যের আশায়। তৃতীয়টি বোধকরি অকালমৃত্যু বরণ করেছে।
ওদের গায়ে পালক গজিয়েছে.....
বুলবুলি প্যারেন্টস - নীড় ছেড়ে খাদ্যের সন্ধানে বের হবার আগে রেলিং এর উপর দু'জন দু'মুখী হয়ে বসে প্রহরারত।